শনিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২২

সাকিবকে খুন করতে তার বাড়িতে, সিরিয়াল কিলার জনি ভাই - থ্রিলার

 বিয়ের পরেই জনি ভাই প্রথম সিগারেট ধরে।

সাধারণত বিয়ের পর পুরুষেরা বউকে খুশি করার জন্য সিগারেট ছাড়ে, সে এক্ষেত্রে উলটো। এখন জনি ভাই রীতিমত একজন চেইন স্মোকার। এই মুহূর্তে সিগারেটের ধুমের জন্য জনির ফুস্ফুস হাসফাস করছে। তবু সে নিজেকে সংযত রেখেই বলল,

- সাকিব ভাই আমি আপনার সব টাকা নিয়ে এসেছি।

ওর হাতের ব্রিফকেস দেখেই বোঝা গেলো সে টাকা নিয়ে এসেছে। তবে মাত্র সাড়ে চার লক্ষ টাকা আনার জন্য এতো বড় ব্রিফকেস লাগে সেটা জানা ছিলো না। জনি ভাই বসে আছে সাকিব হাসানের ড্রয়িং রুমে। জনি ভাই আর সাকিবের পরিচয় ব্যবসায়ীক সুত্রে। দু'জনেই প্রকাশনীর ব্যবসা করে। একসাথে তারা বিজনেস শুরু করলেও জনি ভাই সাকিবের মত ব্যবসা দাঁড় করাতে পারে নি। মাঝে মাঝে সাকিবের থেকেও টাকা ধার নিতো। তবে ভালোয় ভালোয় টাকাটা এনেছে সেটাই সাকিবের স্বস্তি।


আতিফ আসলাম সাহেব নাদিয়া আলীর পূর্ব পরিচিত। নাদিয়া আলীর প্রতি তার দূর্বলতা ছিলো।


তবু সাকিব কৃত্রিম আন্তরিকতার ভাব দেখিয়ে বলল,

- আরে এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই আগে চা কফি তো খাও তারপর না হয় টাকার কথা শোনা যাবে।

- সাকিব ভাই চা পড়ে খাবো আগে একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শুনেন। তারপর না হয় টাকাটা দেই।

সাকিব অনিচ্ছা সত্ত্বেও হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়লো।

-আচ্ছা ভাই বলো তোমার ইন্টারেস্টিং গল্প। দেখি কেমন গল্প বলো তুমি।

জনি ভাই একটু মৃদু হাসলো। তবে সে খানিকটা থেমে গলার স্বর গম্ভীর করে গল্প শুরু করলো,

- একবার আমি লয়ার নাদিয়া আলীর বাসায় একটা চিঠি নিয়ে গিয়েছিলাম।

-কোন নাদিয়া আলী। ঐ যিনি বছর খানেক আগে কার এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিলেন?

- হ্যাঁ। ওনার বাসায় প্রবেশ অনেক ঝক্কি ঝামেলার বিষয়। তবে আমি প্রবেশ করতে পেরেছিলাম। চিঠিটা তার হাতে দেওয়ার পর আমি বললাম, ম্যাডাম আপনার জন্য একটা বিশেষ চিঠি আছে।

বড়লোকরা সাধারণত দর্শনপ্রার্থীদের ড্রয়িং রুম থেকে কোনো রকমে বিদায় দেন। এজন্য এনারা এনাদের ড্রয়িং রুম বিদেশী এনটিক সাজিয়ে খুব ঝকঝকে তকতকে রাখার ব্যবস্থা করেন। যাতে বাহিরের লোক বুঝতে পারে তিনি কোন ক্যাটাগরীর বড়লোক। তবে ক্রিমিনাল লয়ার নাদিয়া আলী খানিক ব্যতিক্রম। নানা রকম একচেটিয়া মনভাবের জন্য তিনি বেশ পরিচিত। তিনি তার বাড়িতে একাই থাকেন। তার স্বামী তাকে ছেড়ে গিয়েছিলো নাকি তিনিই তার স্বামীকে ছেড়েছিলেন সেটা আজোও রহস্যই রয়ে গেছে।

আমাকে দেখে তার প্রথম বিরক্তই লেগেছিলো। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে খানিকক্ষ্ণ আমাকে পরখ করলেন। অতঃপর চিঠিটি হাতে নিলেন। এনভেলোপে মোড়ানো চিঠি । এনভেলোপে প্রেরকের কোনো ঠিকানা নেই, তবে প্রাপকের জায়গায় নাদিয়া আলীর বাড়ির ঠিকানা। মেইল কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ করলে ইন্টারাপ্ট হবার সম্ভবনা থাকে বিধায় তার ক্লাইন্টদের মধ্যে অনেকেই এভাবে গোপন চিঠি লিখে বিশ্বস্ত লোক মারফত পাঠায়। আমাকেও দেখে ভাবলেন তেমনই একজন।

এনভেলোপ ছিড়ে চিঠিটি বের করলেন। তবে খানিকক্ষন আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি চিঠিটি নিয়ে পড়তে শুরু করলেন-

ওনার হাতে দেবার আগে আমি চিঠিটি কয়েকবার পড়েছিলাম। আমার চিঠির লেখা গুলো প্রায় হুবুহু মনে আছে।

সাকিব হঠাৎ বলল, 

- আচ্ছা চিঠিটা কার লেখা ছিলো সেটাই তো বললে না।

-আরে ভাই বলছি। আমার কথা মন দিয়ে শুনলেই বুঝতে পারবেন। শুনেন চিঠিতে কি লেখা ছিল আমি বলছি।

“নাদিয়া আলী,

আপনার খোঁজ খবর আমি অনেকদিন ধরেই করছি। কিছু মনে করবেন না। এছাড়া আমি আপনাকেও চিনলেও আপনি আমাকে হয়তো এখন চিনবেন না।

আমি যখন সবে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছি তখন আপনারা বাসা বদল করে আমাদের এলাকায় এসে উঠলেন। ঐ এলাকার সবচেয়ে বড় বাড়িটাই ছিলো আমাদের। সবাই হাজি সাহেবের বাড়ী নামে চিনতো। আমি ছিলাম ঐ বাড়ীর ছোট ছেলে, আর সবচেয়ে আদুরে সন্তান। যতই আদুরে হইনা কেনো আমাদের বাড়ির রীতিনীতি ছিলো খুব কড়া। 

আমাদের বাড়িতে ইসলামিক রীতিনীতি মানতে হতো। মেয়েরা পর্দার আড়াল থেকে বেরুতে পারবে না, জোরে কথা বলতে পারবে না বাহিরের লোকদের সামনে আসতে পারবেন না ,এমনকি বাড়ির ছেলেরাও বাহিরের কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে পারবে না ইত্যাদি। আমার বড় ভাইয়েরা সবাই মাদ্রাসা থেকে পাস করেছিলেন। কেবল আমিই ছিলাম ব্যতিক্রম। বাবা তার সব ছেলে মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষায় পড়াশোনা করালেও তাঁর ইচ্ছা ছিলো তার এক সন্তানকে ডাক্তারী পড়াবেন। ছোট ছেলে বলে হয়তো আমাকেই মনোনীত করলেন ডাক্তারী পড়ানোর জন্য। 

আপনি হয়তো ভাবছেন এসব কথা আপনাকে কেনো বলছি। অবশ্যই কোনো কারণ আছে বলেই আপনার সময় নষ্ট করছি। আপনার যদি বিরক্ত লাগে আপনি এখনই এই চিঠিটা ডাস্টবিনে ফেলে দিতে পারেন। আর যদি না ফেলে থাকেন বাকি লেখাটা পড়ুন।

আমার নাম আতিফ আসলাম। আপনি বোধ হয় এতক্ষণে আমাকে চিনতে পেরেছেন। চিনতে না পারলে মনে করিয়ে দিচ্ছি- ঐ যে এক ঘোর বর্ষার রাতে আপনার বাবার হঠাৎ বুকে ব্যাথা উঠলো কোনো ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছিলো না। আমিই তো সে রাতে আপনার বাবার প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে দিয়েছিলাম। তেমন কিছুনা জিহবার নিচে কয়েক ফোটা নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে করে দিয়েছিলাম। নেহাত মেডিকেল স্টুডেন্ট ছিলাম বলে সে যাত্রায় রক্ষা।

তবে সেদিন আপনার বাবার উপকার করলেও আমার কিন্তু বেশ ক্ষতি হয়েছিলো। কি ক্ষতি হয়েছিলো জানতে চান? বলছি...বলছি। সে রাতে আমি প্রথম আপনাকে দেখছিলাম। 

আমাদের বড় মসজিদের নেয়ামত মুন্সি বলতো ,জান্নাতের হুর থেকে চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু প্রথমবার ভালো ভাবে কোনো মেয়ের দিকে চোখ পড়ায় হয়তো আপনাকে আমার জান্নাতের হুররে চেয়েও সুন্দরী মনে হয়েছিলো। পৃথিবীর একুশ বাইশ বছরের এক সাধারণ তরুনীর এতো রূপ থাকতে পারে আমার জানা ছিলো না। নাকি তখন আমি কোনো ঘোরের মধ্যে ছিলাম জানিনা। সারাদিন আপনার চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠতো। 

কতবার চেষ্টা করতাম আপনাকে ভুলে থাকবার। একটা মেয়েকে মনের প্রতিবিম্বে ধরে রাখা পাপ । তবে সৃষ্টিকর্তা যেমন নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন প্রেমে পড়া পাপ তবু মানুষের মনে এমন আবেগ দিয়ে দেন কেনো আমি জানিনা। হয়তো বান্দাকে পরীক্ষা করবার জন্য। আমি হয়তো সেই পরীক্ষায় উতড়ে গিয়েছিলাম। আপনার চেহারাটা বারবার মনের ভেতর পাক খেলেও নিজেকে সংযত রেখেছিলাম। আমি যে পরিবারে বড় হয়েছি সে পরিবারে এসব প্রেম আবেগের কথা বললে আমার বাবা আমাকে হয়তো জ্যান্ত পুঁতে ফেলতেও দ্বিধা করতেন না।

হঠাৎ শ্রাবণের এক বিকেলে আপনার বিয়ে হয়ে গেলো। যেদিন আপনার বিয়ে হয়েছিলো সেদিন কি করেছিলাম জানেন? ও, আপনার তো না জানারই কথা। তেমন কিছু করিনি সারারাত মসজিদে বসেছিলাম। নফল নামাজ পড়লাম আপনার আগামী জীবনের জন্য দোয়া করলাম। কিন্তু নিজের মনের ওপর কি আর নিয়ন্ত্রন রাখা যায়? শেষ রাতে হুহু করে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। 

মজার বিষয় কি জানেন জীবনের একান্ন বছরের দ্বারপ্রন্তে এসেও আমি আজোও বিয়ে করে উঠতে পারিনি। এই কারনে আমার পরিবারও আমার খোঁজ নেয়না। আমি হঠাৎ আপনাকে চিঠি লিখলাম কেনো জানিনা। শুধু চারটা লাইন মাথার ভেতর ঘুরছে-

হেথা যে গান গাইতে আসা আমার,

হয়নি সে গান গাওয়া।

আজো কেবলি সুর সাধা,আমার

কেবল গাইতে চাওয়া।

ভালো থাকবেন। 

ইতি,

আতিফ আসলাম।“

চিঠিটি পড়ার পর তিনি থম্থমে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,” আতিফ আসলাম সাহেব কোথায় আছেন? ওনার কাছে যাওয়া যাবে কি?”

আমার মুখে কোনো ভাষা যোগাচ্ছিলো না। তবু মৃদু স্বরে বল্লাম, ম্যাডাম আতিফ আসলাম সাহেব পরশু ভোর রাতেই মারা গেছেন। তিনি আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকতেন। দু দিন কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে আজ বাধ্য হয়েই ওনার ফ্ল্যাটের দরজা ভাঙ্গি। দেখি বিছানায় শোয়া । লাশ প্রায় পচঁতে শুরু করেছিলো। ডাক্তার বললেন ঘুমেই স্ট্রোক করে মারা গেছেন। জীবনের শেষ চিঠিটা তিনি আপনাকে লিখে গেছেন। টেবিলের ওপরেই চিঠিটা ছিলো।

কিন্তু দুখের ব্যাপার হচ্ছে ওনার বাড়ীর ঠিকানায় গিয়ে দেখি কেও থাকে না সেখানে। সবাই বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছেন। কোনো আত্মীয় স্বজনের সাথেও পরিচয় নেই। এখন ওনার লাশ কোথায় দাফন করি?

নাদিয়া আলী অনেক্ষন চুপ করে ছিলেন। একটা মানুষ দূর থেকে এতো ভালোবাসতো তিনি সেটা ঘুনাক্ষরেও টের পাননি। আর লোকটাও এখন পৃথিবীতে তিনি সেই ধাক্কাটা সামলে উঠলেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললেন,

“ওনাকে আমার বাড়ির বাগানে কবর দিবো। “ 

তিনি আর কোনো কথা বললেন না। আমার সামনেই কাদতে লাগলেন।

সাকিব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আসলেই গল্পটা ইন্টারেস্টিং।

জনি ভাই সাকিবের কথা শুনে উদ্ভ্রান্তের মত হাসলো।

-সাকিব ভাই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি। মজার ব্যাপার কি জানেন আতিফ আসলাম স্ট্রোক করে মারা জাননি। তাকেও খুন করা হয়েছে। কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার।

জনির কথা শুনে সাকিবের চোখ যেন বিস্ফোরিত হয়ে উঠলো। তবু জনি ভাই স্বাভাবিক ভাবেই বলতে লাগলো।

- আপনি হয়তো জানেন না। ব্যবসা শুরুর আগে আমি ছিলাম পেশাদার জুয়ারী। জুয়ার লাভের টাকা দিয়েই ব্যবসা শুরু করেছিলাম। এখনো আমি জুয়া খেলি। কিন্তু ব্যবসা তো ভালো যাচ্ছিলোই না , তার উপর জুয়াতে অনেক টাকা খুইয়েছি। বাধ্য হয়ে আতিফ আসলাম সাহেবের থেকে টাকা ধার নিয়েছিলাম। কিন্তু টাকা ফেরত দিবো কিভাবে কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। 

আতিফ আসলাম সাহেব নাদিয়া আলীর পূর্ব পরিচিত ছিলো সেটা ঠিক। তিনি ছিলেন অবিবাহিত আর নাদিয়া আলীর প্রতি একসময় তার দূর্বলতা ছিলো সে গল্পও একদিন করেছিলেন আমার কাছে। তখনী মাথায় বুদ্ধি খেলো গেলো। আমি ঠান্ডা মাথায় আতিফ আসলাম সাহেব কে খুন করলাম। এসব বানোয়াট চিঠি লিখে লাশটা চাপিয়ে দিয়ে এলাম নাদিয়া আলীর ঘাড়ে।

নাদিয়া আলী ছিলেন ক্রিমিনাল লয়ার। আমার উপর যে তার সন্দেহ হতে পারে সে কথা ভুলেই গিয়েছিলাম । সন্দেহ করেছিলেন ঠিকই তাই ওনাকেও গাড়ি চাপা দিয়ে পথ থেকে সরিয়ে দিলাম। হা হা হা.........

জনি ভাই ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলো। যেনো খুন গুলো করতে পেরে সে বেজায় খুশি। সাকিব থরথর করে কাপছে। জনি ভা দেখে মনে হচ্ছে তার উপর দিয়ে একটা সাইক্লোন বয়ে গেছে।

জনি ভাই হাসি থামিয়ে বলল, সাকিব ভাই একটা বিষয় কি জানেন, এতো বুদ্ধি আমি কোথায় পেলাম? প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করার পর অনেক বই পড়তে শুরু করলাম। কত থ্রিলার আর কত নোভেল। তবে আমি বুদ্ধিটা পেয়েছি সানি লিওন নামে এক তরুন লেখিকার গল্প থেকে। তার চমৎকার প্রতিফলন এই খুনগুলো। 


জনি ভাই তার মুখে কৌতুকের হাসি ফুটিয়ে বলল,

-দুঃখের ব্যাপার হলো আপনার টাকাও আমি যোগার করতে পারি নি। কিন্তু কি আর করবো আপনি যে হারে টাকার জন্য তাগাদা দিচ্ছিলেন। আপনারও একটা ব্যবস্থা নিতে হবে দেখছি। 

জনি ভাই ব্রিফকেসটা খুলল। সেখানে টাকাতো নেই ই বরং চমৎকার ডিজাইন করা একটা চাইনিজ কুড়াল রাখা। 

সাকিব তখনো থরথর করে কাপছে। তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। জনি ভাই এগিয়ে আসছে ধীরে। ধীর পায়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন